
গত এক দশকে বাংলাদেশে নজরদারি প্রযুক্তি ও স্পাইওয়্যারের আমদানি ও ব্যবহার এমন মাত্রায় নেয়া হয়েছে যা মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করেছে। ক্ষমতা দীর্ঘ করতেই দেশে নজরদারি যন্ত্রের আমদানি বৃদ্ধি করে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। এ বিষয়ে প্রায় এক বছর গবেষণা চালিয়েছে টেকগ্লোবাল ইন্সটিউট নামের একটি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি ৭০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা। সেখানে আওয়ামী লীগের আমলে কোন কোন নজরদারি যন্ত্র কেনা হয়েছে এবং তা ব্যক্তির ডিজিটাল স্বাধীনতার ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে তার বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
‘দ্য ডিজিটাল পুলিশ স্টেট: সার্ভেইলেন্স, সেক্রেসি অ্যান্ড স্টেট পাওয়ার ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শেষ নয় বছরে অন্তত ১৬০ ধরনের নজরদারি সরঞ্জাম ও স্পাইওয়্যার আমদানি বা মোতায়েন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে আইএমএসআই ক্যাচার, ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টর, সেলিব্রাইট, ফিনফিশার, প্রেডেটরের মতো শক্তিশালী স্পাইওয়্যার। এসব প্রযুক্তি মূলত বিদেশি কোম্পানি তথা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে গোপনে কিনে আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নজরদারি প্রযুক্তি কেনাবেচায় ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, কানাডাসহ একাধিক দেশের কোম্পানি জড়িত ছিল। ইসরাইলের কাছ থেকে কেনা সেলিব্রাইট ইউএফইড, এনএসও গ্রুপের পেগাসাস ও ইন্টেলেক্সা কনসোর্টিয়ামের স্পাইওয়্যার সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস ও হাঙ্গেরির মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ২০১৫-২০২৫ সালের মধ্যে নজরদারি প্রযুক্তি ও স্পাইওয়্যারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে অন্তত ৪০ মিলিয়ন ডলার ইসরাইল থেকে কেনা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় ক্রেতা বাংলাদেশের ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)। যারা একাই ব্যয় করেছে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। তারা ডীপ প্যাকেট ইন্সপেকশন, ইন্টারনেট ট্রাফিক ডিক্রিপশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ ও মোবাইল ডিভাইস থেকে তথ্য আহরণের মতো সক্ষমতা অর্জন করেছে। পুলিশ, র্যাব ও ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) ও ব্যাপকভাবে মোবাইল ও ওয়াই-ফাই ইন্টারসেপ্টর, সিগন্যাল জ্যামার ও সেল নেটওয়ার্ক মনিটরিং অবকাঠামো সংগ্রহ করেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে নজরদারি সরঞ্জাম ক্রয় বেড়ে যায়, যা রাজনৈতিক বিরোধী ও গণ-বিক্ষোভ দমন এবং শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যবহার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ২০২২ সালে নজরদারিতে সর্বোচ্চ বার্ষিক ব্যয় রেকর্ড হয়। যার পরিমাণ ৮৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে এনটিএমসির ব্যয় ছিল ৭৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার।
এসব নজরদারি কাঠামো টিকে আছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১, ঔপনিবেশিক যুগের টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট ১৮৮৫ এবং ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি অ্যাক্ট ১৯৩৩- এর মতো আইনের ওপর ভর করে। এই আইনের মাধ্যমে সরকার, গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্কে নজরদারির বিস্তৃত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে এই কার্যক্রমে নেই কোনো বিশেষায়িত সংসদীয় নজরদারি কমিটি, কার্যকর বিচারিক তদারকি বা স্বচ্ছতা। প্রতিবেদন সতর্ক করেছে- প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ ডিজিটাল স্বৈরতান্ত্রিকতার দিকে আরও এগিয়ে যাবে, যেখানে নজরদারি নাগরিক নিরাপত্তা নয়, বরং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ সময়: ০:২৭:১৯ ৮৩ বার পঠিত