সংকীর্ণ রশির ওপর ভারসাম্য রক্ষা কেন পুতিনের সফর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক মহাশিক্ষা

প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » সংকীর্ণ রশির ওপর ভারসাম্য রক্ষা কেন পুতিনের সফর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক মহাশিক্ষা
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫



কেন পুতিনের সফর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক মহাশিক্ষা

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নয়াদিল্লি সফর এবং ২৩তম ভারত-রাশিয়া বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলন কেবল আরেকটি কূটনৈতিক বৈঠক নয়; এটি একটি ভাঙনমুখী বিশ্বের ভেতরে ধারাবাহিকতার এক শক্তিশালী বার্তা। তীব্র ভূরাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও এই বৈঠক আবার প্রমাণ করল- দুই দেশের ‘বিশেষ ও সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারত্ব’ প্রকৃতই পারস্পরিক লাভজনক এবং ভারত তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষায় অটল।শীর্ষ বৈঠকে বিস্তৃত পরিধিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে- বাণিজ্য ও প্রযুক্তির জন্য ভিশন ২০৩০ রোডম্যাপ, জ্বালানি ও পারমাণবিক সহযোগিতায় নতুন উদ্যোগ, বহুল আলোচিত রিলোস প্রতিরক্ষা লজিস্টিকস চুক্তি, পাশাপাশি শ্রমিক চলাচল, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামুদ্রিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সমঝোতা ইস্যুতে। কিন্তু প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি ছিল দৃশ্যপটের আড়ালে।

ওয়াশিংটন যখন রাশিয়ার ওপর ব্যাপক শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট। তাহলো মস্কোকে বিচ্ছিন্ন করা, তাদের অর্থনীতি দুর্বল করা এবং পশ্চিমা দাবিতে (দুই দেশকেই) বাধ্য করা। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতি নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলে না। রাশিয়াকে বিপর্যস্ত করার বদলে নিষেধাজ্ঞা তাকে পূর্বমুখী হতে বাধ্য করেছে। সেখানে ভারত তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়েছে। অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা হলো মার্কিন শুল্ক রাশিয়ার পথ বন্ধ করেনি; বরং ভারতের বৈশ্বিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করেছে।সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে জ্বালানি বাণিজ্যে। পশ্চিমা ক্রেতারা দূরে সরে গেলে রাশিয়া ছাড়কৃত মূল্যে তেল দিতে শুরু করে। বিশাল জ্বালানি-চাহিদাসম্পন্ন ভারত সুযোগ লুফে নেয়। রুশ তেল আমদানি বেড়ে যায়, ভারতের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। রাশিয়ার জন্য ভারত হয় প্রধান বাজার; ভারতের জন্য রাশিয়া হয় বাস্তববাদী সহযোগী। উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়াকে শাস্তি দেয়া; ফল দাঁড়াল দুই দেশের মধ্যে লাভজনক বাণিজ্য করিডর গঠন। সাম্প্রতিক মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় আমদানিকারকদের রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমাতে বাধ্য করলেও সম্পর্কের এই করিডর এখন আরও বহু ক্ষেত্রে ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

স্বাভাবিক অংশীদার

এটি শুধু তেলের লেনদেন নয়; বরং এর চেয়েও গভীর বাস্তবতা আছে। পশ্চিমা অর্থায়ন ও প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন রাশিয়ার প্রয়োজন এমন অংশীদার, যারা তার থেকে আমদানি করবে, তার রপ্তানি গ্রহণ করবে এবং কূটনৈতিক বৈধতাও দেবে। এই তিন ক্ষেত্রেই ভারত যথার্থ অংশীদার। ভারতের জন্য এ সম্পর্ক কৌশলগত স্বাধীনতাকে আরও শক্তিশালী করে। নিষেধাজ্ঞা মস্কোর কাছে নয়াদিল্লির গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে এবং এশিয়াকেন্দ্রিক এক নতুন সংহতির পথ খুলেছে। শীতল যুদ্ধ থেকে ভারত নিজের পররাষ্ট্রনীতিকে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড় করিয়েছে- অপর পক্ষকে অসন্তুষ্ট না করে বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। আজও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করছে ভারত, পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গেও ঐতিহাসিক সখ্য রক্ষা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এ ভারসাম্যকে আরও কঠিন করে তুলেছে, কিন্তু একই সঙ্গে আরও দৃশ্যমান করেছে। ভারত জাতিসংঘে রাশিয়াকে নিন্দা জানানো প্রস্তাবে বিরত থাকে, রুশ তেল আমদানি করে, আবার একই সময়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি অংশীদারিত্ব আরও বাড়ায়। এটি ভণ্ডামি নয়, এটাই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, বা বহুমুখী অংশীদারিত্বের বাস্তব প্রয়োগ।

চাপের মুখে স্থির থাকা

রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হতে পারে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারতকে রাশিয়ার সহায়ক বলে দেখানো হতে পারে, যা কূটনৈতিক চাপ আনতে পারে। তাই এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন সাবধানী কূটনীতি, স্পষ্ট ব্যাখ্যা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সামঞ্জস্য করার ক্ষমতা। তবু সম্ভাবনাগুলো বড়। পশ্চিম ও রাশিয়া- উভয় পক্ষের কাছেই ভারত অপরিহার্য দেশ হিসেবে উঠে আসে। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত হয়ে ওঠে এক ‘সুইং স্টেট’- ভারসাম্য বদলে দিতে এক সক্ষম শক্তি। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের তিনটি স্তম্ভ আছে। তা হলো-১. প্রতিরক্ষা- সম্পর্কের মেরুদণ্ড:ভারতের সামরিক সরঞ্জামের ৬০-৭০ ভাগ রুশ বা সোভিয়েত উৎস থেকে সংগৃহীত। তাই অতিরিক্ত কোনো চুক্তি না হলেও খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভবিষ্যৎ আপগ্রেড নিশ্চিত করতে উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ অপরিহার্য। রিলোস চুক্তি দুই দেশের সামরিক সহযোগিতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে- বিশেষত রাশিয়ার আর্কটিক সুবিধাগুলোতে ভারতের প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং স্পষ্ট বলেছেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা ‘স্থিতিশীল’।২. বাণিজ্য ও অর্থনীতি-সম্পর্কের পুনর্গঠনদুই দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক বাণিজ্য লক্ষ্য করেছে। ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অগ্রগতি হয়েছে। রুপি-রুবল লেনদেন সম্প্রসারণ, ডলার-বহির্ভূত পেমেন্ট সিস্টেম, রুপে-মির সংযোগ, ব্রিকস পেমেন্ট করিডর- সবই চলমান আলোচনায়। রাশিয়ার জন্য ভারতীয় বাজার নতুন সুযোগ; কারণ পশ্চিমা দরজা বন্ধ হওয়ায় রাশিয়া আবার ভারতের দিকে তাকাচ্ছে। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ক্ষুদ্র পারমাণবিক রিয়্যাক্টর ও ভাসমান নিউক্লিয়ার প্লান্টে সহযোগিতা, গুরুত্বপূর্ণ খনিজে অংশীদারিত্ব- এগুলো বৈঠকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এছাড়া ‘শ্রম গতিশীলতা’ চুক্তি এসেছে, যা বৈধ শ্রমিক নিয়োগ ও অনিয়মিত অভিবাসন প্রতিরোধে সহায়ক হবে।৩. বহুমাত্রিক স্বায়ত্তশাসন-ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্রএই সফর দেখিয়ে দিয়েছে ভারত কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে না। পশ্চিমা আপত্তিকে উপেক্ষা করে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন এবং রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখা ভারতের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষমতার প্রকাশ।উপসংহার:সম্পর্ক লেনদেনভিত্তিক নয়, কৌশলগতপুতিনের সফর প্রমাণ করেছে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক কেবল প্রতীকী নয়, কার্যকরী। ভারতের নিরাপত্তা ও জ্বালানি স্থিতি বজায় রাখতে রাশিয়াকে প্রয়োজন; রাশিয়ার জন্য পশ্চিমা অবরোধ ভেদ করে এশিয়ায় শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে ভারত অপরিহার্য। ৮০ বছরের পুরোনো অংশীদারিত্ব আবারও শক্তিশালী হলো প্রতীক নয়, বাস্তব ফলাফলের মাধ্যমে। বৈশ্বিক অস্থিরতার মাঝেও দুই দেশ জানিয়ে দিল- তাদের সম্পর্ক টিকে থাকবে, কারণ এটি স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট, গভীর এবং পারস্পরিক উপকারী।(লেখক ভারতের প্রভাবশালী একজন রাজনীতিক। ২০০৯ সাল থেকে তিনি কেরালার তিরুবনন্তপুরম থেকে সংসদ সদস্য। তিনি একজন লেখক এবং সাবেক কূটনীতিক। এনডিটিভি থেকে তার লেখার অনুবাদ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:০৮:৩৯   ১৩ বার পঠিত  




আন্তর্জাতিক’র আরও খবর


সংকীর্ণ রশির ওপর ভারসাম্য রক্ষা কেন পুতিনের সফর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক মহাশিক্ষা
ভারতে অবস্থান প্রসঙ্গে  হাসিনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে : জয়শঙ্কর
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক রিপোর্ট ‘সভ্যতাগত বিলুপ্তির’ মুখোমুখি ইউরোপ
আল জাজিরার বিশ্লেষণ ভারতকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন জোট চায় পাকিস্তান, সম্ভাবনা কতোটুকু?
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ
ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ ও বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থিতিশীলতার জন্য চীনের ভূমিকা চায় ফ্রান্স
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনা ‘নীতিগত ভুল’: জাতিসংঘ মহাসচিব
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প সতর্ক সংকেত: প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ দেশের অভিবাসন আবেদন স্থগিত
গাজায় নতুন গণকবরের সন্ধান হত্যার পর বুলডোজার দিয়ে বালি চাপা

Law News24.com News Archive

আর্কাইভ