
ঔপনিবেশিক শোষণের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে বৃটেনের অনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি এক ঐতিহাসিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। এতে বলা হয়েছে, বর্ণবাদী বিজ্ঞান তত্ত্ব তৈরিতে বিতর্কিত ও বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বৃটেনর অন্যতম ও মর্যাদাপূর্ণ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি দাসপ্রথা ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বিপুল অর্থ অনুদান পেয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি, এখনও বিশ্ববিদ্যালয়টি এসব অনুদানের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য গার্ডিয়ান।
এতে বলা হয়, আফ্রিকান দাস, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন এবং বর্ণবাদী শোষণের সঙ্গে যুক্ত দাতাদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বিশাল অঙ্কের অনুদান পেয়েছিল। যা বর্তমান মূল্যে কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন পাউন্ডের সমান। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্যতম প্রধান দুটি ভবন- ওল্ড কলেজ ও পুরোনো মেডিকেল স্কুল এই অনুদানের টাকায় নির্মিত হয়েছে। এসব অনুদান বর্তমানে প্রায় ৩০ মিলিয়ন পাউন্ড সমমূল্যের, যা মজুরির বৃদ্ধির হারে হিসাব করলে ২০২ মিলিয়ন পাউন্ড এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারে হিসাব করলে ৮৪৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সমান।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনও এমন অনুদান গ্রহণ করে আসছে, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন পাউন্ড। এই অর্থ এসেছে দাসপ্রথা, ঔপনিবেশিক দখল ও ‘ছদ্মবিজ্ঞান’-এর সঙ্গে জড়িত দাতাদের কাছ থেকে। এই অর্থ দিয়ে আজও বিভিন্ন লেকচার, সেমিনার, পুরস্কার ও ফেলোশিপ পরিচালিত হচ্ছে। ১৮ ও ১৯ শতকে এডিনবার্গ হয়ে উঠেছিল শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী অধ্যাপকদের আশ্রয়স্থল। এসব শিক্ষকরা ভুয়া ‘জাতিগত বিজ্ঞান’ (রেসিয়াল স্যুডো-সায়েন্স) তৈরি করতেন। এসব তত্ত্বের ভিত্তিতে আফ্রিকানদের জাতিগতভাবে সবচেয়ে নিচু শ্রেণির মানুষে পরিণত করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল ও তদন্তের প্রধান উদ্যোক্তা স্যার পিটার ম্যাথিসন বলেন, ‘তদন্তের ফলাফলগুলো মেনে নেওয়া কঠিন হলেও এডিনবার্গ একটি ‘সুনির্দিষ্ট স্মৃতি’ নিয়ে চলতে পারে না।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘শোষণমূলক ব্যবস্থা ও চিন্তাধারায় যারা ভুক্তভোগী, তাদের প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে— বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৫টি তহবিল গড়ে উঠেছে আফ্রিকান দাসপ্রথা-সংক্রান্ত উৎস থেকে এবং আরও ১২টি তহবিল ভারত, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত দাতাদের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি তহবিল এখনও সক্রিয়, যেগুলোর বর্তমান মূল্য ৯ দশমিক ৪ মিলিয়ন পাউন্ড। ১৮০০ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে থাকা প্রায় ৩০০টি খুলি মস্তিষ্কবিদরা (ফ্রেনোলজিস্ট) দাস ও ঔপনিবেশিত দেশগুলোর জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির এক শতাংশেরও কম শিক্ষক-কর্মচারী এবং মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থী কৃষ্ণাঙ্গ, যা বৃটেনের মোট জনসংখ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের আনুপাতিক হার (৪ শতাংশ) থেকে অনেক কম। প্রতিবেদনের লেখকদের মতে, স্কটিশ এনলাইটেনমেন্টের কেন্দ্র হিসেবে ১৮শ ও ১৯শ শতকে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ও অবদান নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে- বিশেষ করে যখন প্রতিষ্ঠানটি অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড হিউমের মতো বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের কাজের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একটি অংশ দাসত্ব, উপনিবেশবাদ এবং জোর করে দখলকৃত দেহ, শ্রম, অধিকার, সম্পদ, ভূমি ও জ্ঞানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য প্রতিবেদকরা দাসপ্রাপ্ত অনুদান থেকে অর্জিত অর্থ কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘু পটভূমি থেকে আসা শিক্ষাবিদদের নিয়োগ, এবং বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদ বিষয়ক গবেষণা ও শিক্ষায় ব্যয় করার আহ্বান জানান। ৪৭ দফা সুপারিশে সমৃদ্ধ এই পর্যালোচনায় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়কে ইন্টারন্যাশনাল হলোকাস্ট রিমেম্বারেন্স অ্যালায়েন্স (আইএইচআরএ) নির্ধারিত ইহুদিবিদ্বেষ সংজ্ঞা প্রত্যাহারেও উৎসাহিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এই সংজ্ঞা ইসরাইলের গাজা ও পশ্চিম তীরে পরিচালিত নীতিমালা নিয়ে মুক্ত আলোচনা বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও, বৃটেনের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই এই সংজ্ঞা অনুসরণ করে। এছাড়া, ইসরাইলি সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কোম্পানিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিয়োগ দ্রুত প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার পিটার ম্যাথিসন জানান, এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সক্রিয়ভাবে পর্যালোচনা করছে। তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে তিনি আইএইচআরএ সংজ্ঞা প্রত্যাহার বা ইসরাইল-সংযুক্ত কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিতে নারাজ। এছাড়া তিনি জানান, দ্য গোল্ড স্টুয়ার্ট নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নন্দিত শিক্ষক ১৭৯০-এর দশকে তার শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছিলেন যে শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ানরা জাতিগতভাবে শ্রেষ্ঠ। অথচ তিনি ও তার শিক্ষক অ্যাডাম ফার্গুসন ছিলেন আমৃত্যু দাসপ্রথাবিরোধী।
স্যার ম্যাথিসন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের কঠিন ও অস্বস্তিকর ইতিহাস মেনে নিতে হবে- এটাই এ পর্যালোচনার মূল শিক্ষা।’ বৃটেনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত বিস্তৃত ডিকলোনাইজেশন পর্যালোচনা এই প্রথম বলে দাবি করেন তিনি। ডিকলোনাইজেশন মানে হলো, কোনো একটি দেশ বা অঞ্চলের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করা। প্রিন্সিপাল ম্যাথিসন বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সুপারিশ গ্রহণ করবে, তবে কিছু বিষয়ের জন্য আরও আলোচনা ও বাইরের তহবিল প্রয়োজন হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় নতুন একটি ‘বর্ণ ও বর্ণবাদ পর্যালোচনা বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করবে, যা বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ ও কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী সহিংসতা নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষার জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগে কাজ করবে। তারা দাতাদের খোঁজ ও কমিউনিটি স্পেসের জন্য জায়গা সরবরাহেও সহায়তা করবে। ম্যাথিসন আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কেন কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থী ও কর্মীর সংখ্যা এত কম তা বোঝার জন্য অনেক কাজ করতে হবে। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বৃত্তি চালু করবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করবে।সূত্র: ইউএনবি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯:৫৬:৪৪ ১৪ বার পঠিত