
দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়ার মতো এক যুগান্তকারী সামরিক ঘটনার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশে। আঙ্কারার সঙ্গে ঢাকার একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে। যার আওতায় অত্যাধুনিক এসআইপিইআর দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও তুরস্কের সক্ষমতা-প্রমাণিত যুদ্ধ-ড্রোন হাতে পেতে চলেছে ঢাকা।
প্রাথমিকভাবে এটিকে কেবল একটি অস্ত্র চুক্তি মনে হলেও, বাস্তব প্রেক্ষাপটে এটি আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর মাঝে সুকৌশলে নিজেদের পথ তৈরি করে নেওয়া একটি জাতির স্বাধীনতার সাহসী সামরিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশের জন্য এটি তার ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে তুরস্কের জন্য এটি বৈশ্বিক মঞ্চে নিজেদের সামরিক-শক্তির কৌশলী প্রদর্শনী। আর প্রতিবেশী ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে এটি এক নতুন, অপ্রত্যাশিত এবং নিরন্তর কৌশলগত মাথাব্যথার জন্ম দিয়েছে।
তুরস্কের কাছ থেকে উচ্চ প্রযুক্তির সামরিক সরঞ্জাম কেনার এই উদ্যোগটি কোনো খেয়ালি বিষয় নয়, বরং বাস্তব ও সরাসরি হুমকির অনিবার্য জবাব। ঢাকা আর তার আকাশসীমার অরক্ষিত দশা উপেক্ষা করতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলেছে। চীন ও রাশিয়ার তৈরি সামরিক বিমান ঘন ঘন বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করছে। এমনকি মিয়ানমারের দিক থেকে ছোঁড়া আর্টিলারি শেলও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়েছে। প্রতিটি ঘটনা ঢাকার সরকারের ওপর তীব্র রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। যা প্রমাণ করে নিজেদের সীমান্ত সুরক্ষিত করা এখন জরুরি। সমস্যা হলো, কার্যকরভাবে এই সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের কাছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই।
দেশের বিদ্যমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত পুরোনো এবং কম পাল্লার বিভিন্ন সিস্টেমের মিশ্রণ। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর এবং কক্সবাজারের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত থেকে গেছে।এখানে প্রতিবেশী ভারতের শক্তিও একটি ফ্যাক্টর। দেশটির বিশাল সামরিক সক্ষমতা বাংলাদেশের দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক স্থিতিশীল, তবুও কোনো সামরিক পরিকল্পনাকারীই ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিশাল গুণগত ও সংখ্যাগত শ্রেষ্ঠত্ব উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই সামরিক আধুনিকীকরণের এই প্রচেষ্টা দ্বৈত উদ্দেশ্য সাধন করে। এক- মিয়ানমার থেকে আসা তাৎক্ষণিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরক্ষা তৈরি করা। দুই- শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অসামঞ্জস্যতাকে সূক্ষ্মভাবে পুনর্বিন্যাস করা।
তুরস্কের এই প্যাকেজটি প্রায় নিখুঁত সমাধান এনে দেবে। মধ্যম পাল্লার হিসার-ও প্লাস এবং দূরপাল্লার এসআইপিইআর সিস্টেমের সংমিশ্রণ কেবল ঘাটতিই পূরণ করবে না, এটি একেবারে শুরু থেকে একটি আধুনিক, সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা ঢাল তৈরি করবে। প্রথমবারের মতো ঢাকা তার সম্পূর্ণ আকাশসীমা প্রতিরক্ষা করার ক্ষমতা পাবে, যা যেকোনো সম্ভাব্য আগ্রাসনের ব্যয়কে এমন স্তরে নিয়ে যাবে যা গুরুত্ব সহকারে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।
দীর্ঘমেয়াদে ড্রোন উৎপাদন সুবিধাটি সম্ভবত আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি চিরস্থায়ী অস্ত্র ক্রেতা হওয়ার ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার বাংলাদেশের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার নিজস্ব মানবসম্পদ এবং শিল্প ভিত্তির ওপর বিনিয়োগ করছে। এটি আত্মনির্ভরশীলতার দিকে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ, যা ঢাকাকে ভবিষ্যতে নজরদারি, গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং হামলার সক্ষমতার জন্য নিজস্ব সরবরাহ শৃঙ্খলের ওপর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেবে।
চীন, রাশিয়া বা পশ্চিমের সঙ্গে একচেটিয়াভাবে নিজেদের ভাগ্য না বেঁধে বাংলাদেশ সচেতনভাবে তার সামরিক পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করছে। একটি স্বাধীনচেতা, শক্তিশালী ন্যাটো সদস্য দেশ তুরস্ককে তার সামরিক বলয়ে আনার মাধ্যমে ঢাকা অন্যান্য সব অংশীদারের সঙ্গে তার দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা, বাংলাদেশ কারও ‘ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র’ হবে না।তুরস্কের জন্য এই চুক্তিটি কেবল অস্ত্র বাণিজ্য নয়, এটি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী তুরস্কের মহৎ দৃষ্টিভঙ্গির মুকুটস্বরূপ। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের ‘এশিয়া অ্যানিউ’ নীতিকে সুসংহত করাও বটে। এটি বাণিজ্য, সংস্কৃতি এবং সামরিক-শিল্প অংশীদারিত্বের মিশ্রণের মাধ্যমে এই মহাদেশজুড়ে তুর্কি প্রভাব বিস্তারের একটি নিপুণ কৌশল।
এই খবরটি নয়াদিল্লির জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এটি হয়তো এখনই চার-ঘণ্টার বিপদ সংকেত নয়, কিন্তু এটি ভারতের কৌশলগত পরিকল্পনাবিদদের জন্য এক নিরন্তর, ধুকধুক করা মাথাব্যথা। ভারতের সামরিক শক্তি হুমকিতে পড়ছে এ জন্য তারা উদ্বিগ্ন নয় বরং তাদের আরামদায়ক কৌশলগত হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাচ্ছে বলেই তারা চিন্তিত। একটি বিশ্বাসযোগ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আধুনিক স্ট্রাইক ড্রোনে সজ্জিত বাংলাদেশি সামরিক বাহিনী হবে ভিন্ন এক শক্তি। এই সক্ষমতা যেকোনো দেশের আপৎকালীন পরিকল্পনা, সামরিক হস্তক্ষেপ বা জবরদস্তির ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
ভারতের জন্য এটি বিশেষত জটিল সমীকরণ। কারণ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ তুরস্ক, চীন নয়। প্রতিবেশীর মাঝে চীনের প্রবেশকে মোকাবিলা করার জন্য নয়াদিল্লির কাছে একটি প্রতিষ্ঠিত কৌশল থাকলেও, একটি ন্যাটো সদস্যের কাছ থেকে বাংলাদেশের সামরিক সরঞ্জাম আমদানি ভারতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। এই পদক্ষেপ প্রকারান্তরে ঢাকার প্রধান সামরিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চীনের ভূমিকাকে লঘু করেছে। সামগ্রিকভাবে, এই সামরিক লেনদেন ভারতের কূটনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে এবং তাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কেও এর প্রভাব অনুভূত হবে।
লেখক: মোহাম্মাদ ওবাইদুল্লাহ হলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং স্কলার। পাশাপাশি ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন মিসিসিপি’তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩০:৪৪ ৪৫ বার পঠিত