
বুক ভরা হাহাকার। বাড়িঘর নেই। মাটিতে মিশে গেছে সব। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। তার মধ্যে প্রিয়জনের শেষ চিহ্ন খুঁজে ফিরছেন গাজাবাসী। ধ্বংসস্তূপ সরাতেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে কংকাল। গলিত লাশ। চেনার উপায় না থাকলেও স্বজনরা জানেন তাদের ঘরে বোমা হামলার সময় পরিবারের কোন কোন সদস্য ছিলেন। কারা নিখোঁজ। এমনি করেই একে একে লাশের সন্ধান মিলছে। গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে কমপক্ষে ১৩৫ ফিলিস্তিনির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ইসরাইলের দুই বছরব্যাপী গণহত্যামূলক যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতির সুযোগে উদ্ধারকর্মীরা অবশেষে ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাগুলোতে প্রবেশ করতে পেরেছেন। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, শনিবার সারাদিনে কমপক্ষে ১৩৫টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন আল জাজিরা। এছাড়া গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে মৃতদেহ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩টি মরদেহ আনা হয়েছে আল-শিফা হাসপাতালে। ৬০টি মৃতদেহ আল-আহলি আরব হাসপাতালে (গাজা সিটি) এবং অন্যগুলো নুসেইরাত, দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনুসের বিভিন্ন হাসপাতালে পৌঁছেছে। চিকিৎসা কর্মকর্তারা আলাদা করে জানিয়েছেন, শুক্রবার ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত একজন পরে মারা গেছেন। গাজা সিটির দক্ষিণে ঘাবুন পরিবারের ১৬ সদস্য ভোররাতে বাড়িতে বোমা হামলায় নিহত হয়েছে। শেখ রাদওয়ানে একজন এবং খান ইউনুসের কাছে আরও দুজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এই হামলাগুলোর কোনোটি হয়েছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ইসরাইলি সেনারা যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু এলাকা থেকে সরে যায় এবং উপকূলীয় আল-রাশিদ সড়ক আবার খুলে দেয়, তখন দশ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষের দিকে বেদনাভরা যাত্রা শুরু করেন। আল জাজিরার তারেক আবু আজম নুসেইরাত থেকে জানাচ্ছিলেন- শিশু, নারী, বৃদ্ধ- সবাই গাড়ি, ভ্যান, গাধার গাড়ি, ফার্নিচারে বোঝাই করে গাজা সিটির দিকে যাচ্ছিলেন। পরিবারগুলো তাদের অস্থায়ী তাঁবু খুলে নিয়ে গেছে, যেন তা ভাঙা ঘরের ওপর আবার বসাতে পারে। তিনি আরও বলেন, এই ফেরা ঐতিহাসিক। কিন্তু মানবিক সংকট লাঘবে এখনই বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন। গাজা সিটি প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। কোনো অবকাঠামো নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। বিদ্যুৎ নেই। শুধু পড়ে আছে পোড়া ইট-পাথরের কঙ্কালসার দেহ। দেইর আল-বালাহ থেকে সাংবাদিক মোয়াথ কাহলুত জানান, ফিরে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য এখন অতি জরুরি হচ্ছে অস্থায়ী তাঁবু ও মানানসই আশ্রয়। হাতে যা সামান্য আছে তাই নিয়ে তারা অনিশ্চিতের পথে হাঁটছে।
অকল্পনীয় ক্ষয়ক্ষতির পরও ফিলিস্তিনিরা ফিরে যেতে বদ্ধপরিকর। নিজের অস্থায়ী তাঁবু গাড়িতে তুলতে তুলতে নায়েম ইরহিম বলেন, আমি গাজা সিটিতে যাচ্ছি, যদিও ওখানে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। কোনো অবকাঠামো নেই, বিশুদ্ধ পানি নেই। সবকিছু ভীষণ কঠিন। কিন্তু তবু আমাদের ফিরতে হবে। আমার ছেলে মারা গেছে, মেয়েরা সবাই আহত। তবুও আমি ফিরতে চাই। তাঁবু খাটাবো, যেভাবেই হোক বেঁচে থাকব। অনেকের জন্য গাজা সিটিতে ফেরা মানে শুধু ছাইয়ের কাছে ফেরা। তবু কাহলুত বলেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি দখলের মধ্যেও অসাধারণ স্থিতিশীলতা দেখিয়েছে। তাদের প্রত্যেকটি ফিরে আসা কেবল পুনরাগমন নয়, এটি একপ্রকার প্রতিরোধ আর আশার প্রতীক।
ইসরাইলের এই গণহত্যামূলক যুদ্ধ থেকে বেঁচে থাকা এক নারী আয়শা শামাখ বলেন, আমাদের বাড়িগুলো দেখতে চাই, যে বাড়িগুলো যুদ্ধের শুরুতেই ধ্বংস হয়েছিল। আমাদের সন্তানদের ওপর তলার মেঝে ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তবুও আমি বর্ণনা করতে পারব না যুদ্ধবিরতির আনন্দটা। গাজা সিটি থেকে সাংবাদিক ইব্রাহিম আল-খালিল জানান, মানুষের মুখে একসাথে শোক আর আনন্দÑঅবসন্ন চোখে মিশে আছে ঘরে ফেরার ব্যথা ও আশার আলো। অনেকে জানেন না তাদের বাড়ি এখনো দাঁড়িয়ে আছে কিনা। তবুও তারা ফিরছেন আশায় বুক বেঁধে। উত্তরে কঠিন যাত্রা শেষে আহমেদ আবু শানাব বলেন, আমরা প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করেছি। জায়গা ছিল না, ঘুমানোই সম্ভব হয়নি। আরেক বাসিন্দা মারিয়াম আবু জাবাল বলেন, আমরা অজানায় ফিরে এসেছি। জানি না বাড়ি টিকে আছে কিনা। আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করি, আমাদের বাড়িটা যেন এখনও দাঁড়িয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১:৩১:২৫ ৪৬ বার পঠিত