নেতাকর্মীদের অপরাধে সম্পৃক্ত করেন হাসিনা

প্রথম পাতা » জাতীয় » নেতাকর্মীদের অপরাধে সম্পৃক্ত করেন হাসিনা
বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫



নেতাকর্মীদের অপরাধে সম্পৃক্ত করেন হাসিনা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল নির্দেশদাতা ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। শুধু প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই নন, দলের সভাপতি হিসাবেও তিনি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অপরাধ সংঘটনের জন্য নির্দেশদাতা ছিলেন। ট্রাইব্যুনালে দাখিল হওয়া বিভিন্ন অডিও-ভিডিও পরীক্ষায় দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের নিশ্চিহ্ন করতে দলীয় লোকজনকে নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে টেলিফোন কথোপকথনেও একইরকম নির্দেশনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তার নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশের মাধ্যমে জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ অপরাপর অপরাধ সংঘটন করেন যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্যসাবুদে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আওয়ামী শাসনের সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনা প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় লোকদের দানবে পরিণত করেন। জনগণের বিরুদ্ধে দলীয় লোকদের ব্যবহার করেন। বিশেষ করে জুলাই আন্দোলনে দেশজুড়ে মানুষ হত্যায় তাদের সম্পৃক্ত করেন। এ অপরাধের দায় দলীয় লোকদের পাশাপাশি শেখ হাসিনার ওপর বর্তায়। ফলে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়া উচিত।

এদিকে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগেও (ফরমাল চার্জ) বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিপীড়ন চালানোর নির্দেশনার বিষয়টি উঠে আসে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। আসামী হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারক মো. মঞ্জুরুল বাছিদ ও বিচারক নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার।

ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে ২০০৮ সালের ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচন, ভোটারবিহীন ও নিশি রাতের নির্বাচনসহ দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, প্রায় সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জঘন্য অপরাধ করেছে। যা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ইনু। আন্দোলন চলাকালীন সারা দেশে ১৪০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। ২৫ হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে গুরুতর আহত করা হয়। আসামি হাসানুল হক ইনু ছিলেন এসব অপরাধ সংঘটনের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী ও নির্দেশদাতা।

দেশি-বিদেশি সহায়তায় আওয়ামী লীগ বিশৃঙ্খল ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে : অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাকালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ দেশে একটি বিশৃঙ্খল ও সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যার ফলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য করা হয়। যার সূত্রপাত হয়েছিল, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে। ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উদ্যোগে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। যা ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বা ‘এক-এগারোর সরকার’ নামে পরিচিতি পায়। এ সরকার সেনাবাহিনীর সহায়তায় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। এতে ব্যর্থ হয়ে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে ১৩০টি আসনের সীমানা বদল করে। তারা অবৈধভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার অধীনে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে। ২০০৮ সালে প্রহসন ও ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে ভোটারবিহীন, নিশিরাতের ভোট এবং আমি ও ডামির নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম জারি রাখেন শেখ হাসিনা।

৩৮৩ জন এখনো নিখোঁজ : আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬১১ জন ব্যক্তি নিখোঁজ হন। অর্থাৎ শেখ হাসিনার বাহিনী এদের গুম করে। এর মধ্যে ৩৮৩ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদন ৮৬ জন গুমের সংখ্যা উল্লেখ করে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন থেকে আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপকতা, নৃশংসতা ফুটে ওঠে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুম করার তীব্রতা এতটাই গভীর ছিল যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র ্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র ্যাব) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এ ছাড়া কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখানো হয়, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের প্রায়ই আওয়ামী লীগ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে গোপন স্থানে কীভাবে আটক রাখা হয়েছিল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে ৭ হাজারের বেশি মামলা : অভিযোগে বলা হয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে ৭ হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা হয়। এর ৮০ শতাংশ মামলা তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে করা হয়েছে। এসব মামলার ভুক্তভোগী ছিলেন তৎকালীন সরকারের সমালোচক, বিরোধীদলীয় সদস্য, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিচারিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী, অবাধ ও রাজনৈতিক প্রয়োগের মাধ্যমে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসনকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে আদালতকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। দমন-পীড়নের ফলে ভিন্নমতাবলম্বী লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদসহ সব পর্যায়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। নির্যাতনের ফলে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেন লেখক মুশতাক আহমেদ। অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার পর সারা দেশে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় তাদের ওপর পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা একের পর এক হামলা চালাতে থাকে। সরকার পুলিশ, বিজিবি ও সোয়াতকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এ সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার জন্য জাতিসংঘের মনোগ্রামযুক্ত সাঁজোয়াযান ব্যবহার করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চরম আকার ধারণ করলে সাধারণ জনগণ, এমনকি শ্রমিক ও রিকশাচালকরাও তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়।

আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার : অভিযোগে বলা হয়, আন্দোলন বেগবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনার নির্দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন শুরু হয়। তিনি জাতিকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে আন্দোলনকারীদের নৈরাজ্যকারী হিসাবে চিত্রিত করেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রতি সন্ধ্যায় ‘কোর কমিটি’ বৈঠক হতো। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকতেন। মূলত সেখানেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনের নীলনকশা তৈরি হতো।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ভারী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলন থেকে তাদের বিরত রাখতে চেয়েছিলেন। সারা দেশে বিশেষত, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে নৃশংস হামলা চালানো হয়। যার ফলে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হন। শেখ হাসিনা ড্রোন উড়িয়ে আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার করে তাদের গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। এমনকি কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশও দেন। আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর পদ্ধতিগতভাবে ও ব্যাপক মাত্রায় হামলা চালায়। র ্যাব সদস্যরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টারের সহায়তায় আক্রমণ পরিচালনা করে। বিজিবি সদস্যরা প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমণ শানিত করে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আন্দোলনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফিল্ম ফুটেজ পরীক্ষা করে। তারা পুলিশ এবং আধাসামরিক বাহিনী কর্তৃক নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শটগান, চাইনিজ রাইফেল, সাউন্ড গ্রেনেড, স্নাইপার রাইফেল, টিয়ারগ্যাস ইত্যাদি প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৪০:০৮   ৫০ বার পঠিত  




জাতীয়’র আরও খবর


সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে প্রতারণা, সতর্ক করলো পুলিশ
হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য শেষ, বাদীর জেরা ১০ নভেম্বর
সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট
সাবেক মন্ত্রী মায়া ও পরিবারের ৮১ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ
বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকারকে অপসারণ
তিন শতাধিক বিচারককে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে ৭ম দিনের আপিল শুনানি চলছে
স্ত্রী-কন্যাসহ সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের আয়কর নথি জব্দ
হাসিনাসহ পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মামলায় আরও ১১ জনের সাক্ষ্য
হাসিনার রায় বিলম্বিত করার নতুন কূটকৌশল, নভেম্বরে রায় অনিশ্চিত

Law News24.com News Archive

আর্কাইভ