
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের হত্যা-পরবর্তী ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তনের জন্য দায়িত্বরত চিকিৎসককে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ মাহফুজুর রহমানের কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে উপাধ্যক্ষসহ সিটি এসবির পুলিশ সুপার সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ, স্বাচিপের রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি চন্দন উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই, এনএসআই এবং পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা বাইরে অবস্থান করছিলেন। তারা তাদের ইচ্ছামতো ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্য চাপ দেন। তা না করলে ব্যবস্থা নেওয়াসহ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করার ভয়ভীতি দেখান। বুলেটের আঘাতের পরিবর্তে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়েছে মর্মে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করতে চাপ দেওয়া হয়। পুলিশের চাপে শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাঁচবার বদলাতেও হয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ছিলেন।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চাপা দিতে তাকে দিয়ে মনগড়া ময়নাতদন্ত রিপোর্ট করাতে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রযন্ত্র এমন কোনো চেষ্টা নেই যে করেনি। সেসময় এই চিকিৎসক কতটা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে একটি সত্য রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই স্মৃতি বর্ণনা করেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা একটি মামলায় ১৮তম সাক্ষী হিসাবে তিনি জবানবন্দি দেন। রোববার চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষগ্রহণ সম্পন্ন হয়। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিন ট্রাইব্যুনালে অপর তিনজন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। তারা হলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী মো. গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলাম এবং কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম। পরে তাদের জেরা করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এ নিয়ে ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য সম্পন্ন হয়েছে।
আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, আব্দুস সোবহান তরফদার, বিএম সুলতান মাহমুদ, গাজী এমএইচ তামিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, সাইমুম রেজা তালুকদারসহ অন্য প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন।
১০ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১ হাজার ৪০০ আন্দোলনকারীকে হত্যার নির্দেশ প্রদান, উসকানি ও প্ররোচনাসহ ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’-এর ৫ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সাবেক আইজিপি মামুন ইতিমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি তিনি এ মামলায় ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। রোববার তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সোমবার পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করেন ট্রাইব্যুনাল।
জবানবন্দিতে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডাক্তার মো. রাজিবুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত আমি নিজেই করি। যথানিয়মে তার শরীরে পিলেট পাওয়া যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে বহু ‘পিলেটবিদ্ধ’ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে আবু সাঈদ মারা গেছেন মর্মে আমি প্রতিবেদন দিই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে রিপোর্টটি দিলে পুনরায় তা তৈরি করতে বলা হয়। এরপর ভাষাগত পরিবর্তন করে আবারও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই রিপোর্টও নেননি তারা। তৃতীয় রিপোর্টও জমা দিই। এভাবে একে একে পাঁচবার লিখতে হয় আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট। চতুর্থবারের মতো রিপোর্ট দেওয়ার আগে ২০২৪ সালের ৩০ জুলাই নিজের কক্ষে এই চিকিৎসককে ডেকে নেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল মাহফুজুর রহমান। ওই কক্ষে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন সিটি এসবির পুলিশ সুপার সিদ্দিক, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি মারুফ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি চন্দন।
আর কক্ষের বাইরে ছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআইসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তা। কক্ষে ডেকে নিয়ে তারা আমাকে ‘বুলেট ইনজুরির’ পরিবর্তে ‘হেড ইনজুরি’ ও ‘নিউরোজেনিক শক’ কথা উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিতে চাপ দেন। আমার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে বলেও তারা জানান। রাজি না হলে একপর্যায়ে আমাকে ২ সপ্তাহের ছুটির প্রস্তাব দেন। একই সঙ্গে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে ঘুরে আসার প্রলোভন দেখান। তারা বলেন, ২ সপ্তাহের জন্য ছুটি দিচ্ছি। থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে ঘুরে আসেন। তবু আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পরিবর্তন করে দিন। জবাবে পাসপোর্ট নেই বলে জানান এই সাক্ষী। পরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলেন তারা। তখন এই চিকিৎসক বলেন, আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে মর্মে রিপোর্ট দিলে বিশ্বের মানুষ ডাক্তার সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে। এরপর স্বাচিপের সভাপতি ডা. চন্দন বলেন, আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে চায়, সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখব।
এত কিছুর পরও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসিনি। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ আমার দেওয়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আমি আবু সাঈদের শরীরে ‘পিলেট ইনজুরির’ বর্ণনা দেই। তবে রিপোর্টে ‘গানশট’ শব্দটি লিখিনি বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
এ সাক্ষী আরও বলেন, আমাকে অনবরত হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি সত্য রিপোর্ট দিয়েছি। আগে যে তিনটি রিপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে পেরেছি। এসব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এ সময় আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশদানকারী, হত্যার সহায়তাকারীসহ জড়িত সবার বিচার চান চিকিৎসক রাজিবুল।
হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনাসহ অন্যান্যদের মৃত্যুদণ্ড চান কুষ্টিয়ার সাংবাদিক শরিফুল : বিকালে এ মামলায় ১৯তম সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দেন কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম (৩২)। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এদিন কুষ্টিয়া শহরের জেলা পরিষদের কাছে ছাত্র-জনতার মিছিল নিয়ে গেলে পুলিশ উপপরিদর্শক মুস্তাফিজের নেতৃত্বে ৮-১০ জন হেলমেট পরিহিত লোক আমাদের ওপর শটগানের গুলি ছোড়ে। এতে দুই হাতে গুলি লাগলে আমি আহত হই। কিছুক্ষণ পর আমাকে পেছন থেকে ফের গুলি করে। এতে আমি মাটিতে লুঠিয়ে পড়লে দুজন ছাত্র আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার শরীরে তিনবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। আমার শরীর থেকে ৬২টি পিলেট বের করা হয়। ডাক্তার বলেছেন, আমার শরীরে আরও ৫০০-এর অধিক পিলেট রয়েছে, যা বের করা সম্ভব নয়। এ সময় শরিফুলের গুলিবিদ্ধ দুই হাতের এক্সরে ফিল্মটি ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়।
শরিফুল ইসলাম আরও বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট দিনের বেলায় কুষ্টিয়ায় পুলিশের গুলিতে ৬ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। রাতে আনন্দ মিছিল শেষে বাড়ি ফেরার পথে আরও দুই আন্দোলনকারীকে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসব ঘটনার নির্দেশদাতা হলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর, আজগর আলী, সদরখান, মানব চাকি, গৌরব চাকি, যুবলীগ নেতা বাবুল, রাজন ও এসআই মুস্তাফিজ। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সবার মৃত্যুদণ্ড চান সাক্ষী।
এদিন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম-খুনসহ নির্যাতনের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৬ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল-১।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:০৮:৪২ ৬৯ বার পঠিত