বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫

স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ

প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ
শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫



স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশ ত্যাগ করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ক্ষমতা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই ঘটনার এক বছরের বেশি সময় পর এখনো নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। ওই শূন্যতার মুহূর্তে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তা আজ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

দীর্ঘদিন ধরে যেগুলোকে প্রান্তিক প্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেগুলোর প্রভাব এখন মূলধারায় দেখা যাচ্ছে। যা দেশের স্বাধীনতা-উত্তর ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সমালোচকেরা বরাবরই অভিযোগ করেছেন যে শেখ হাসিনার শাসন ক্রমেই কঠোর ও কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠেছিল, যার আড়ালে অন্যান্য শক্তিশালী গোষ্ঠীর উত্থান অনেকটাই অদৃশ্য রয়ে গিয়েছিল।একই সঙ্গে, রাষ্ট্রক্ষমতার অত্যধিক প্রভাবের কারণে এমন অনেক গোষ্ঠীর সামাজিক বিস্তার আড়ালে ছিল। বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে নাগরিক সমাজের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্বগ্রহণ এ পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে বিস্তৃত এনজিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রভাব তৈরি করা এই মহল রাজনৈতিক আলোচনায় আরও দৃঢ় অবস্থান নেয়।

বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন এনজিও নেতা ও গণবুদ্ধিজীবী নির্বাচন, দুর্নীতি, পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে ‘স্বাধীন কণ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ তাদের ওপর আস্থা রাখত। গণমাধ্যমের কিছু অংশও তাদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিত। কিন্তু ৫ আগস্টের পরবর্তী ঘটনাবলি এসব ধারণাকে পুনর্বিবেচনার মুখে ঠেলে দিয়েছে।ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠার পর দেখা যায়,  অনেক এনজিও নেতা ও বুদ্ধিজীবী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অবলীলায় কাজ করছেন। সংবিধান সংস্কার ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন বিষয়ে যৌথ আলোচনা তাদের মধ্যে এক ধরনের মতাদর্শিক ঘনিষ্ঠতার আভাস দেয়, যা অতীতে স্পষ্ট ছিল না।

দীর্ঘদিন ধরে অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, মৌলবাদী প্রবণতা কওমি বা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ফল সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে। ৯০ শতাংশের বেশি পদে বিজয়ী হয় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। বিএনপির ছাত্র সংগঠন, যা ঐতিহাসিকভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করত, তারা সমর্থনের এক-তৃতীয়াংশও পায়নি।

এই আকস্মিক উত্থান রাজনৈতিক মহলকে বিস্মিত করেছে। যদিও অনেকেই বছরের পর বছর এর ইঙ্গিত পেয়েও সেটিকে গুরুত্ব দেননি। শেখ হাসিনার পতনের পূর্ববর্তী বিক্ষোভেও এই পরিবর্তনের ছাপ ছিল স্পষ্ট। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের স্লোগান সাধারণত কবিতার মতো মাধুর্যপূর্ণ হলেও, এবার স্লোগানগুলো ছিল রূঢ়, ক্রুদ্ধ এবং নগরজীবনের কাঁচা রূপ থেকে উঠে আসা প্রত্যয়।অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়- দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু সম্পাদকও উচ্ছ্বসিত যুবকদের সঙ্গে এমন স্লোগান তুলছেন, যা স্বাভাবিক সময়ে মূলধারার রাজনীতিতে অকল্পনীয় ছিল। অনেকের কাছে এটি সামাজিক মানসিকতার গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা অভিভাবকেরাও অনায়াসে মেনে নিচ্ছেন।

এই রূপান্তর দেশের উদারপন্থী মধ্যবিত্তকে অসহায় ও হতাশ করেছে। কেউ কেউ নতুন করে মৌলবাদের বিরোধিতার অঙ্গীকার করছেন। আবার অনেকে বহুদিনের উদ্বেগ থেকে সন্তানদের বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা বাড়াচ্ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সময়ে পশ্চিমা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো ভিসা নীতিতে কঠোরতা এনেছে।

বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ যারা মনে করেন দেশকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে এগোতে হবে- তাদের কাছে এসব ঘটনাপ্রবাহ উদ্বেগজনক। ৫ আগস্টের পর এনজিও অভিজাত, অনুকূল গণমাধ্যমকর্মী এবং ধর্মপ্রাণ নতুন প্রজন্মের ছাত্রদের যে নতুন জোট দৃশ্যমান হয়েছে, তা সমাজে যে পরিবর্তন ঘটছে সেটিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।

বাংলাদেশ কি এখনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গভীরতর পরিসরে প্রবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পারবে- তা স্পষ্ট নয়। তবে একটি সত্য আজ অস্বীকার করা কঠিন, ৫ আগস্টের ঘটনা এবং পরবর্তী দিনগুলো দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর বহু অদৃশ্য বাস্তবতাকে উন্মোচিত করেছে।

লেখক: স্বদেশ রায়।

লেখাটি ইউনাইটেড নিউজস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত তার প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ০:২০:৩৭   ২৭ বার পঠিত