![]()
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। জবানবন্দিতে তিনি বলেছেন, গত বছরের ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে তারা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন। সেদিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন থেকে ডিবি পরিচয়ে কিছু লোক তাকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। ওই রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা প্রদানের জন্য চাপ দেয়। এতে রাজি না হওয়ায় ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করা হয়। পরে ২৪ জুলাই সকালে আসিফকে নিকেতনের সেই স্থানে রেখে যায় সাদা পোশাকদারীরা। বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ উপদেষ্টার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারেন যে, সেখানেই তাকে গুম করা হয়েছিল। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে আমাদের গুম করা হয়। আন্দোলন দমনে সব কার্যক্রমের জন্য তারা দুজন দায়ী।
এদিকে জবানবন্দি শেষে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে উপদেষ্টা আসিফ সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই আন্দোলনে যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত তারা পালিয়ে বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। তাদের ফেরাতে আইন রয়েছে, বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের ফেরাতে যথাযথভাবে সরকার কাজ করছে। তিনি বলেন, গুমের মামলায় যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের এই কার্যক্রম মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে মনে করেন তিনি।
বেলা পৌনে ৩টার দিকে আসিফ মাহমুদ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য শুরু করেন। চলে বিকাল পৌনে ৫টা পর্যন্ত। এ মামলার ১৯তম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দিতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পুরো বর্ণনা তুলে ধরেন এই উপদেষ্টা। তার অবশিষ্ট সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৬ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। বাকি দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, আয়নাঘর থেকে ছাড়া পেয়ে আমি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য ভর্তি হই। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামও একই হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের নজরদারিতে রাখেন। আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ২৬ জুলাই সেখান থেকে নাহিদ ইসলাম, আবু বাকের মজুমদার ও আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাস্সুমকে আনা হয় ডিবি কার্যালয়ে। সেখানে আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন ডিবি প্রধান হারুনুর রশীদ এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে আমাদের ওপর চাপ ও হুমকি দিতে থাকেন।
আসিফ বলেন, আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। বারবার বলা হয় যে, তাদের নির্দেশেই তুলে আনা হয়েছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে। তারা আরও বলেন যে, দয়া করে আমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। ডিবি তাদের লিখিত একটি বক্তব্য জোরপূর্বক আমাদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে পাঠ করায় এবং সেটি মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে গণমাধ্যমে প্রচার করে। ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহারের উক্ত ভিডিও বার্তা জোরপূর্বক গ্রহণ করা হয়েছিল মর্মে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করি এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই।
উপদেষ্টা বলেন, ৫ আগস্ট ভোর থেকে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশ থেকে সাধারণ জনগণ ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করেন। আমি, সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও সমন্বয়ক মোয়াজ্জেম হোসেন চানখাঁরপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করি। তখন আমরা দেখতে পাই, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা নাজিম উদ্দিন রোডসহ চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। তখন বেলা আনুমানিক ১১টা বাজে। চানখাঁরপুল এলাকায় সেদিন আমরা চার-পাঁচশ আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলাম।
পুলিশের গুলিতে একের পর এক আন্দোলনকারীকে আহত হতে দেখি। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং শটগান ও চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করে। আমার সামনে পুলিশের গুলিতে ২ জন আন্দোলনকারী নিহত হন। পরে জানতে পারি যে, ওই দিন চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুবসহ ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪৫:২৩ ৪৭ বার পঠিত