![]()
জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আদালত অবমাননার এক মামলায় ৬ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই মামলায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দেওয়া হয়েছে দুই মাসের কারাদণ্ড। ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা, মামলার বাদী ও সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং হুমকি দেওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আইনে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। এগারো মাস আগে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালানোর পর এই প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনার সাজা হলো। দেশের পটপরিবর্তনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটাই প্রথম রায়। আইন অনুযায়ী যেদিন তারা আত্মসমর্পণ করবেন অথবা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হবেন সেদিন থেকে এই সাজা কার্যকর হবে।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল উভয়পক্ষের শুনানি শেষ করে বুধবার এই রায় দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, পলাতক থাকায় দণ্ডের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ আপিল করতে পারবেন না। আপিল করতে হলে তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। রায়ের পর রাষ্ট্রনিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবী আমির হোসেন বলেছেন, প্রসিকিউশন থেকে যে বক্তব্য রেখেছেন, তার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। এই সাজার রায়ে আমি সন্তুষ্ট নই। রায় দেখে পরে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা শাকিলের কথিত টেলি আলাপের অডিও ট্রাইব্যুনালের বড় পর্দায় শুনানো হয়।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোন কথোপকথনে, শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়াকে হুমকি দেননি। জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় সারা দেশে যে মামলা হয়েছে-সেসব মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা, ভিকটিম, সাক্ষী, প্রকারান্তরে সবাইকেই তিনি হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতা শাকিলের কথিত টেলি আলাপের একটি অডিও টেপ ভাইরাল হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার এই মামলা হয়। ওই অডিও টেপে বলতে শোনা যায়, ‘আমার বিরুদ্ধে ২২৬টি মামলা হয়েছে, তাই ২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি।’ পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ওই কথোপকথনের ফরেনসিক পরীক্ষা করে ‘সত্যতা’ পাওয়ার কথা জানায়।
এই প্রেক্ষাপটে গত ৩০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনা ও শাকিল আলম বুলবুলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করেন। সেদিন ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গ্রহণ করে ১৫ মে’র মধ্যে অভিযুক্তদের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা জবাব দাখিল না করায় ২৫ মে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও শেখ হাসিনা নিজে উপস্থিত হননি কিংবা কোনো আইনজীবীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেননি। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন।
আইন অনুযায়ী, এ ধরনের মামলায় কোনো পক্ষের জন্য সরকারি খরচে আইনজীবী নিয়োগের বিধান না থাকলেও ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থে’ শেখ হাসিনার পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ দেন আদালত। এ মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্য গত ১৯ জুন এ ওয়াই মশিউজ্জামানকে অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) দায়িত্ব দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ধারাবাহিকতায় শুনানি শেষে বুধবার শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিলেন। আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তাকে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর তানভীর জোহা ও বিএম সুলতান মাহমুদ। অ্যামিকাস কিউরি হিসাবে ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান। শেখ হাসিনার পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
বুধবার শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সারা দেশে ২২৬টি মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা গাইবান্ধা আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আহমেদের সঙ্গে কথোপকথনে বলেছেন, ‘যারা মামলা করেছে, তাদের মারার লাইসেন্স পেয়ে গেছি। এদের বাড়িঘর ভাঙচুরের নির্দেশ দেন তিনি। পুলিশ কর্মকর্তাদেরও হুমকি দেন। কথোপকথনের মাধ্যমে তদন্ত সংস্থার কাছে স্পষ্ট হয়েছে এরা দুজন (শেখ হাসিনা ও শাকিল আহমেদ) সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা মনে করেছেন, এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে ভয় পাবেন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার যে তর্কিত কনভারসেশন, তা পুলিশের সিআইডিকে দিয়ে ফরেনসিক করিয়েছি। তাতে জানা গেছে, এই কনভারসেশন এআই জেনারেটেড নয়, অর্থাৎ এটা শেখ হাসিনা এবং শাকিল আকন্দ বুলবুলের। এই কনভারসেশন প্রথমে একটি দৈনিকে রিপোর্ট হয়, পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ হয়। শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি এ ওয়াই মশিউজ্জামান বলেন, এটা (যে অপরাধ হয়েছে) বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল। তাই এটা অবমাননা হয়েছে।
রায়ের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকে আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আর্গুমেন্ট করি এবং অ্যামিকাস কিউরিও আর্গুমেন্ট করেন। তিনি বলেন, সবার আর্গুমেন্ট শুনে এবং সিআইডির যে ফরেনসিক রিপোর্ট বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তর্কিত এ কনভারসেশনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদী, সাক্ষী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ যারা এ বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদের হত্যা করা এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ তাদের ‘থ্রেট’ করেছেন।
‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এবং ১১-এর ৪ ধারা অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়াকে প্রিজুডিস করার অপরাধ করেছেন। এ অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনা এবং শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দণ্ডিত করেছেন। যেদিন তারা আত্মসমর্পণ করবেন অথবা পুলিশ কর্তৃক ধৃত হবেন সেদিন থেকে সাজা কার্যকর হবে।’
এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তার মধ্যে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান দমানোর চেষ্টায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। জুলাই-আগস্টের দমন-পীড়নে ভূমিকার জন্য দল হিসাবে আওয়ামী লীগের বিচারের জন্যও ইতোমধ্যে আইন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪৮:৫৫ ১১৬ বার পঠিত