![]()
গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের নতুন গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। যারা মানবিক সহায়তা সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হন তাদেরকে বুলডোজার দিয়ে বালি চাপা দিয়েছে দখলদার ইসরাইল বাহিনী। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন। এতে বলা হয়, উপত্যকার জিকিম ক্রসিংয়ের কাছে সহায়তা নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ এবং নিহতদের মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে বালিতে চাপা দেওয়ার প্রমাণ সামনে এসেছে।
জুনে পরিবারের জন্য আটা আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন গাজার বাসিন্দা আম্মার ওয়াদি। যাওয়ার আগেই ফোনের স্ক্রিনে লিখে রেখেছিলেন- আমার কিছু হলে আমায় ক্ষমা করে দিয়ো মা। আমার ফোন যিনি পাবেন, পরিবারকে জানাবেন আমি মাকে খুব ভালোবাসি। পরে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি সেই ফোনটি খুঁজে পেয়ে বার্তাটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। যা ছিল তাদের শেষ খবর। সিএনএন জানিয়েছে, জিকিম সীমান্তের আশপাশে গুলিবর্ষণে নিহতদের দেহ অনেক ক্ষেত্রেই মিলিটারি জোনে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় বুলডোজার চালিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়, আর অনেক দেহ উদ্ধার না হওয়ায় খোলা জায়গায় পচে-গলে পড়ে থাকে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃতদেহ এভাবে পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে- গ্রীষ্মজুড়ে জিকিম এলাকায় ব্যাপক বুলডোজার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। জুনে ঘটে যাওয়া এক হামলার পরের ভিডিওতে দেখা যায় উল্টে যাওয়া একটি ত্রাণ ট্রাকের চারপাশে আংশিক মাটিচাপা পড়ে থাকা দেহ। সাবেক দুই আইডিএফ সদস্য সিএনএনকে জানিয়েছেন, গাজার অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তারা বর্ণনা করেছেন কিভাবে যুদ্ধের সময় ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ অগভীর কবরস্থানে বুলডোজার দিয়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী আইডিএফ দাবি করেছে- তারা মৃতদেহ সরানোর জন্য বুলডোজার ব্যবহার করেনি। তবে তা দিয়ে কবর দেওয়া হয়েছিল কি না সে প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে গেছে। আইডিএফ বলেছে, এলাকা সুরক্ষা, বিস্ফোরকের ঝুঁকি মোকাবিলা কিংবা রুটিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য বুলডোজার ব্যবহৃত হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিশেষজ্ঞ জানিনা ডিল বলেন, যুদ্ধরত পক্ষগুলোর দায়িত্ব নিহতদের এমনভাবে কবর দেওয়া যাতে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়। মৃতদেহ বিকৃত করা বা অসম্মানজনকভাবে কবরস্থ করা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ। জিকিম এলাকায় গুলির মাঝে ত্রাণ বহনকারী ফিলিস্তিনিদের ছুটে আসার একাধিক ভিডিও সিএনএন যাচাই করেছে। এক ভিডিওতে দেখা যায়- একজন ত্রাণ বহনকারীকে পিছন থেকে গুলি করা হচ্ছে। আরেকটিতে আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে আবার গুলি চলছে। এক ত্রাণ ট্রাক চালক বলেন, জিকিম দিয়ে গেলে প্রতিবারই লাশ দেখতে পাই। ইসরাইলি বুলডোজারগুলোকে মৃতদেহ মাটিচাপা দিতে দেখেছি। আরেকজন বলেন- এটা যেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। সেখানে কী ঘটে কেউ জানে না।
জুনের মাঝামাঝি এক ঘটনায় একটি ত্রাণ ট্রাক ঘিরে ধরেন ক্ষুধার্ত মানুষজন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তখনই আইডিএফ গুলি চালায় এবং বহু মানুষ ট্রাকের নিচে পড়ে মারা যান। কয়েক দিন পর সিভিল ডিফেন্সের অ্যাম্বুলেন্স গিয়ে ১৫টি লাশ উদ্ধার করতে পারে, কিন্তু প্রায় ২০টি দেহ উদ্ধার না করেই ফিরে আসতে হয়। কারণ অ্যাম্বুলেন্স ভর্তি হয়ে গিয়েছিল।
এক আইডিএফ সদস্য জানান, ২০২৪ সালের শুরুতে তাদের ঘাঁটির পাশে দুদিন ধরে পড়ে থাকা নয়টি মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়। তিনি বলেন, কুকুরগুলো লাশ টেনে খাচ্ছিল। যে দৃশ্য দেখা ছিল অসহনীয়। মৃতদেহের পরিচয় নথিভুক্ত করার মতো কোনো চেষ্টা হয়নি। ইসরাইলি সৈন্যদের বয়ান সংগ্রহকারী সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’-ও জানিয়েছে- এ ধরনের আরও অনেক সাক্ষ্য তাদের কাছে এসেছে।আম্মার ওয়াদির পরিবার এখনো তার খোঁজ পায়নি। তার মা নাওয়াল মুসলেহ বলেন, ছেলের কথা মনে পড়লেই চোখের পানি থামে না। আমরা যা-ই হোক মেনে নেব। শুধু জানতে চাই, তার কী হয়েছিল। গাজার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল এখন নিখোঁজদের কবরস্থান হয়ে উঠেছে। যেখানে বহু মানুষ যে পথ ধরে ত্রাণ নিতে গিয়েছিলেন, সেই পথই তাদের শেষ যাত্রাপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ২২:০২:৪৭ ৩৫ বার পঠিত