
টানা ১২ দিনের পাল্টাপাল্টি হামলার পর হঠাৎ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা। তার আগে উদ্বেগের এক রাত। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের মিসাইল হামলা ঘিরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়। কিন্তু রাতের সেই শঙ্কা সকালেই শীতল করে দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ঘোষণা দেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ট্রাম্পের এই ঘোষণার শঙ্কা কাটলেও দ্বিধা ছিল সর্বত্র। কী হয়, কী হবে- এমন প্রশ্ন দেখা দেয়। শুরুতে ইরানের তরফে কোনো ঘোষণা না আসায় যুদ্ধ থামবে কিনা এই প্রশ্ন সামনে আসে। যুদ্ধবিরতির আলোচনার মাঝেই ইসরাইল জানায় ইরান ফের হামলা চালিয়েছে। দেশটি ইরানে আবারো জোরালো হামলা চালানোর ঘোষণা দেয়। ইরানের দু’টি রাডার স্থাপনায় হামলাও করে। এতে যুদ্ধ বিরতি ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যদিও মঙ্গলবার দফায় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজস্ব ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন। যুদ্ধরত দুই দেশকে সতর্ক করেন। ইসরাইলকে হুঁশিয়ারি দেন। দিন শেষে অবশ্য ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে। এভাবে যুদ্ধ বন্ধের প্রক্রিয়াকে অনেকটা নড়বড়ে যুদ্ধ বিরতি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ যেকোনো সময় পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ওদিকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর ইরানে সরকার সমর্থকরা বিজয় মিছিল করছেন। দেশটির তরফে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইসরাইল জানিয়েছে, তাদের লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় যুদ্ধ বন্ধ করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও হামলা চালানোয় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। ইরানে ফের হামলার বিষয়ে তেল আবিবকে সতর্ক করেন তিনি। ট্রাম্পের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর নতুন করে আর হামলা না চালানোর কথা জানিয়েছে ইসরাইল।
হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রাম্প। সেখানে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে কী কী করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে দৃঢ় ও সরাসরি নির্দেশনা দেন ট্রাম্প। নেতানিয়াহু অভিযোগ করেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর ইসরাইলে হামলা করেছে ইরান। এর প্রেক্ষিতেই ইরানের রাডার স্থাপনায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে তার বাহিনী। তবে ইরান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে বোঝা যায় উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে চায়। ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, ইসরাইল আর বোমা ফেলো না। সকল বিমান ফিরিয়ে নিয়ে আসে, এখনই। ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন যদি এই যুদ্ধবিরতি বহাল থাকে, তাহলে একে কূটনৈতিক সাফল্য দাবি করার সুযোগ তৈরি হবে। যদিও প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এই সংঘাত আরও তীব্র হবে।
বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া:যুদ্ধবিরতি ঘোষণাকে সতর্কতার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র বলেন, সত্যিই যদি যুদ্ধবিরতি হয় তাহলে একে স্বাগত জানানো যেতে পারে। এদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রশংসা করলেও সতর্ক করেছেন যে পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল রয়ে গেছে।
শেষ মুহূর্তে কঠোর হামলা: ইসরাইলকে লক্ষ্য করে চালানো ইরানের শেষ হামলাটি ছিল বেশ মারমুখী। তেল আবিব জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার আগে ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর বীরশেবাতে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে কমপক্ষে চারজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে। এদিকে তেহরানও বেশ কঠোর হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- শেষ মুহূর্তে মারাত্মক হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। শেষ ২৪ ঘণ্টায় তেহরানের শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আর গত ১২ দিনে ৬১০ জন ইরানি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তেহরানের বাসিন্দারা জানান, তারা ১৩ই জুন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলার একটি রাত সহ্য করেছেন।
কূটনীতি: এই যুদ্ধবিরতিতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ছিল বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। গণমাধ্যমটি বলছে, ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় ছিল কাতার। ইরানকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করায় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ। এ বিষয়ে জ্ঞাত তিনজন কূটনীতিক এ দাবি করেছেন। তারা জানিয়েছেন, কাতারের সহায়তা চেয়েছিলেন ট্রাম্প। পরে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল থানি ইরানের নেতৃত্বের সঙ্গে ফোনালাপ করেন। কার্যত কাতারই ইরানকে ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি করায়। যদিও যুদ্ধবিরতিতে সমঝোতার বিস্তারিত এখনো অস্পষ্ট।
বিনিয়োগকারীদের স্বস্তি:যুদ্ধিবিরতির খবরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে এশিয়ার বাজার। কেননা, যুদ্ধের ফলে জ্বালানির বাজার অস্থির হয়ে ওঠায় বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিনিয়োগকারীরা। মঙ্গলবার শেয়ারবাজারগুলো ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার শেয়ারবাজারে সূচক ৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আর এস অ্যান্ড পি-এর বৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশ। আর যুদ্ধের ফলে তেলের বাজারে যে অস্থিরতা ছিল তা এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
যুদ্ধবিরতি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আরও চ্যালেঞ্জ থাকবে: হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু সেটা নিশ্চিতভাবে জানার উপায় নেই, যতক্ষণ না ইরান আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এখানে আরও কিছু অজানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। আমেরিকার হামলার আগে কী ইরানিরা পারমাণবিক উপাদান ও প্রক্রিয়াজাত যন্ত্রপাতি পরিচিত কেন্দ্রগুলো থেকে সরিয়ে ফেলেছিল? এমন কি কোনো গোপন কেন্দ্র ছিল যা এই হামলায় ধ্বংস হয়নি? এখন আমেরিকার প্রয়োজন ইরানের সঙ্গে একটি কূটনৈতিক চুক্তি, যা নিশ্চিত করবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সম্পূর্ণ, যাচাইযোগ্য ও অপরিবর্তনীয় ধ্বংস। শেষবার যুক্তরাষ্ট্র যখন এরকম একটি চুক্তি করেছিল, সেটি বাস্তবায়নে সময় লেগেছিল দুই বছরের বেশি। সেটিও বাতিল হয়ে যায়, যখন ২০১৮ সালে ট্রাম্প সেই চুক্তি বাতিল করেন। তিনি তখন যুক্তি দেন যে, এটি ত্রুটিপূর্ণ এবং ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র বানানো থেকে থামাতে পারবে না।
বাংলাদেশ সময়: ৭:৫১:২২ ১২ বার পঠিত