রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

৮৮ ভাগ মামলায়ই খালাস আসামিরা

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ৮৮ ভাগ মামলায়ই খালাস আসামিরা
বুধবার, ২৫ জুন ২০২৫



৮৮ ভাগ মামলায়ই খালাস আসামিরা

ঢাকার অধস্তন আদালতে মে মাসে ফৌজদারি অপরাধের ৮৮ শতাংশ মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। সাজা হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ মামলায়। ধর্ষণ, হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর অপরাধের সঙ্গে জড়িতরাও পার পেয়ে যাচ্ছেন। মামলার তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষীর অভাব, দীর্ঘ প্রক্রিয়া, নানাভাবে সময়ক্ষেপণ ও প্রসিকিউশনের দুর্বল ভূমিকার জন্য এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজীবী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা। তাদের শঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষ আস্থা হারাবে এবং অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রতিমাসে ফৌজদারি মামলার রায় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সালের মে মাসে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে নিষ্পত্তিকৃত ১৬৫৬টি মামলার মধ্যে ১৩৯৩টিতে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। সাজার রায় হয়েছে মাত্র ১৯৩টি মামলায়। অন্যানভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭০টি মামলা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, এমনকি পুলিশ আক্রমণের মতো মামলায়ও সাজার হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। ধর্ষণের ২৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ২৭টিতে খালাস পেয়েছেন আসামিরা। সাজা হয়েছে মাত্র ১টি মামলায়। নারী নির্যাতনের ৯৮টি নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ৯৬টিতে। সাজা হয়েছে মাত্র ২টি মামলায়। মে মাসে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত ১০২৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে আসামিরা খালাস পেয়েছেন ৮২৮ মামলায়। সাজা হয়েছে ১৪৭টিতে। অন্যানভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫২টি মামলায়।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পাওয়ার অর্থ সব সময় এ নয় যে মামলাটি মিথ্যা। কারণ, একজন আসামি অনেক কারণেই খালাস পেতে পারেন। যেমন ঘটনা সত্য হওয়ার পরও তদন্তে দুর্বলতার কারণে অনেক সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। আবার ডাক্তারি পরীক্ষা, সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে না হওয়ায় খুন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের মামলা প্রমাণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আলামত নষ্ট হয়ে গেলে সদিচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, মামলা দায়েরের পর অনেক ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ মামলা পরিচালনায় অনীহা দেখায় বা গোপনে আপস করে ফেলে। তখন বাদীপক্ষ সাক্ষ্য দেয় না বা দিলেও যথাযথভাবে সাক্ষ্য না দেওয়ায় আসামি খালাস পেয়ে যান। আবার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণেও মামলা প্রমাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের দুর্বলতার কারণেও আসামি খালাস পান। আবার হয়রানির জন্য ঘটনা যা, তার চেয়ে বাড়িয়ে লিখে অনেক ক্ষেত্রে মামলা হয়, যা সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় না। তাই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়া মানেই তা মিথ্যা, এমনটি বলা যাবে না। কারণ, সাক্ষ্যপ্রমাণে সন্দেহ তৈরি হলে সেক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী আসামি বেনিফিট অব ডাউটের কারণেও সুবিধা পায়। এরপরও সামগ্রিক দিক বিবেচনায় অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি পিপি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকি গণমাধ্যমকে বলেন, ইদানীং রাজনৈতিক যে মামলাগুলো হয়েছিল, সেগুলোয় সাক্ষীর অভাবে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন আসামিরা। যে কারণে খালাসের হার বাড়তে পারে। এছাড়া, বিশেষ করে নারী ও শিশু আইনের অধিকাংশ মামলায় আপস-মীমাংসা হয়ে যায়। মাদকের মামলায় অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না। অধিকাংশ মামলায়ই ভ্রাম্যমাণ সাক্ষী থাকে, যার ফলে পরবর্তী সময়ে সাক্ষীদের পাওয়া যায় না। এজন্য এসব মামলায় স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্য নেওয়া উচিত।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা চেষ্টা করি যাতে অপরাধীর সাজা হয়। সেজন্য পুলিশের তরফ থেকে করণীয়গুলো সুচারুভাবে পালন করা হয়। সুষ্ঠু তদন্তের পর চার্জশিট দাখিল হয়। তিনি বলেন, তদন্তের বিভিন্ন ধাপে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সঠিক অপরাধীকেই চার্জশিটভুক্ত করা হয়। তারপরও নানা কারণে অনেক সময় সাজার হার কমে যায়। যেমন সাক্ষী আসে না, মামলা কম্প্রোমাইজ হয়ে যাওয়া।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটোরিয়াল উপদেষ্টা ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীর সঙ্গে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের কথা হয়। তিনি বলেন, প্রথমত কোনো ফৌজদারি মামলায় আসামি খালাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কতগুলো কারণ থাকে। এক নম্বর কারণ হলো মামলার অভিযোগকারী পক্ষ অ্যাভিডেন্সের মাধ্যমে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ না দেওয়ায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত হলো, অনেক সময় মামলায় সাক্ষীরা আসেন না। এ কারণে অনেক সময় খালাস করে দেন। আবার অনেক সময় আপস-মীমাংসার ভিত্তিতেও আসামিদের খালাস করে দেওয়া হয়। এই ৮৮ শতাংশ যারা খালাস হয়েছেন, যদি সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে খালাস পেয়ে থাকেন, আর প্রসিকিউশন যদি মনে করে এ খালাস অন্যায় হয়েছে, তখন উচ্চ আদালতে অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ খালাসের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারে। আমি মনে করি, যেসব মামলায় খালাস দেওয়া হচ্ছে, তার কপি জেলা বা মহানগর জজ ও পাবলিক প্রসিকিউটরকে দেওয়া উচিত। তখন তারা বিবেচনা করে দেখবেন এই মামলা রাষ্ট্রের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি দেখে এই আদেশ ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হয়েছে, সেক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চতর আদালতে একটা রিভিশন দায়ের করতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ৭:৪৬:০৪   ১০ বার পঠিত