![]()
কয়েক দশক ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি ছিল একরৈখিক একটি সূত্র। তাহলো আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা করা, দলের নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর সব রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করা এবং ধরে নেয়া যে ঢাকার স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে একটি দলের টিকে থাকার ওপর।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই কৌশলকে কঠোর বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়েছে। হাসিনার স্বৈরশাসনের পতন শুধু বাংলাদেশকেই বদলায়নি, ভারতের দীর্ঘদিনের নীতিকেও অচল করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা দেখাচ্ছে, নয়াদিল্লি এখন যেন একদলনির্ভর নীতির লাভক্ষতি নতুন করে বিবেচনা করছে। অনলাইন দ্য ডিপ্লোম্যাটে সাংবাদিক আবু জাকির এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন।তিনি ওই দুটি ঘটনাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, প্রথম ঘটনা হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্য উষ্ণ শুভেচ্ছাবার্তা ও ‘সম্ভব সব সহযোগিতার’ প্রতিশ্রুতি।দ্বিতীয়ত: শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। তিনি শুধু বলেছেন, হাসিনা ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে (ভারতে) এসেছেন’ এবং ‘এখন তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’এই দুটি অবস্থান ভারতের আগের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে স্পষ্টতই ভিন্ন। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে সাধারণ সৌজন্যতার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। মনে করা হচ্ছে এটি সুপরিকল্পিত বার্তা: পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার, যা বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, তার সাথে সম্পর্ক উষ্ণ রাখতে ভারত প্রস্তুত।ভারতীয় গণমাধ্যমের কিছু বিশ্লেষণ বলছে এটি নির্বাচনপূর্ব অবস্থান পুনর্গঠনের ইঙ্গিতও হতে পারে। দুই দেশের সম্পর্ককে একক কোনো দলের ভাগ্যের সঙ্গে বেঁধে রাখা যে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়, এটি যেন নয়াদিল্লি এখন স্বীকার করছে।আরও স্পষ্ট হয় বিষয়টি যখন জয়শঙ্করকে হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। অতীতে ভারত প্রকাশ্যে তাকে ঢালের মতো প্রতিরক্ষা দিত, তাকে নিয়ে সমর্থনসূচক বক্তব্য দিত। এবার তিনি কোনো পক্ষপাত ছাড়াই বলেন- হাসিনা এসেছেন ‘এক পরিস্থিতিতে’, এখন ‘তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ এমন নিরপেক্ষতা ভারতের আগের দশকের আচরণ থেকে তীব্র বৈপরীত্য তৈরি করে, যখন বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বকে প্রায়ই আওয়ামী লীগ সরকারের টিকে থাকার সাথে একাকার করে দেখা হতো।ভারতের পুরোনো নীতির ক্ষতিগুলো এখন স্পষ্ট হয়েছে। একদলনির্ভর নীতির ফল বাংলাদেশে ভারতের ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ বিষয়টি এখন আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ঢাকা ও সাধারণ মানুষের বড় অংশের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে এই পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান।
অমীমাংসিত তিস্তার পানিবণ্টন, শুল্কবাধা, সীমান্তে বারবার হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য বৈষম্য এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রভাব খাটানোর অভিযোগ- এসব অভিযোগ বছরের পর বছর জমতে জমতে তা গভীর ক্ষোভে রূপ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে- ২০২৪ সালের যুবনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থান ছিল কেবল একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিদ্রোহ নয়; এটি ছিল পরোক্ষভাবে বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াও, যারা একটি দায়হীন শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে বলে মনে করা হয়। এই ক্ষোভ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। বহু বাংলাদেশির কাছে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অসম মনে হয়। এর মধ্যে তাদের ধারণা হলো বাণিজ্যে ভারত লাভবান হচ্ছে। নদী সমস্যা ভারতের একতরফা প্রভাবের কারণ। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণহানি একটি উন্মুক্ত অবহেলাকে প্রকাশ করে দেয়। আর রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভারতের হস্তক্ষেপ ঢাকার রাজনীতিকে বিকৃত করেছে।
ভারতে ক্রমবর্ধমান হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রবণতাও বাংলাদেশে উদ্বেগ বাড়িয়েছে, সম্পর্কে এসেছে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার নতুন মাত্রা। প্রতিবেশীকে মানুষ ঘৃণা করে না, ঘৃণা করে অসম সম্পর্ককে।
এ অঞ্চলে ভারতের কোনো বিকল্প নেই। চীন, পাকিস্তান, উপসাগরীয় দেশ বা পশ্চিমা দেশ- কেউই বাংলাদেশের সাথে ভারতের ভৌগোলিক ঐতিহাসিক সান্নিধ্যকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। তাই নয়াদিল্লিকে চাইতে পারে এমন সম্পর্ক, যা সব পক্ষের সাথে সমানভাবে কাজ করতে প্রস্তুত। ভারতের উচিত প্রকৃত রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, বিএনপি থেকে জামায়াত, নতুন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) এবং নাগরিক সমাজসহ সব শক্তির সাথে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ গড়ে তোলা, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সম্মান প্রদর্শন। একইসাথে বেশ কিছু কাঠামোগত সমস্যা সমাধান করা জরুরি। তার মধ্যে আছে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি, বাণিজ্যের শুল্ক বাধা কমানো, সীমান্তে মানবিক নীতি প্রয়োগ করা, ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। যদি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই সম্পর্কের বাস্তব সুফল পায়, তাহলে ভারতের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছা তৈরি হবেই।
ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক আলোচনাও বাংলাদেশকে সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করা উচিত- ভয়ভীতি, অতিরঞ্জন বা অভিবাসনধাঁচের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষোভ তৈরি করে। অন্যদিকে ঢাকারও দায়িত্ব আছে- বৈধ ক্ষোভ এবং অযৌক্তিক ভারতবিরোধী আবেগের পার্থক্য চিহ্নিত করা এবং জাতীয়তাবাদকে দায়িত্বশীল পথে পরিচালিত করা।২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশের রূপান্তর দেখিয়ে দিয়েছে- পুরোনো ফর্মুলা আর কাজে আসে না। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, পরিবর্তিত সমাজকে পুরোনো একদলনির্ভর সম্পর্ক দিয়ে পরিচালনা করা অসম্ভব। ভারত যদি এই মুহূর্তকে ব্যবহার করে আরও সম্মানজনক, ভারসাম্যপূর্ণ ও জনমুখী নীতি গ্রহণ করে, তাহলে গত এক দশকে জন্ম নেয়া ভারতবিরোধী ক্ষোভ কমে আসতে পারে। পারস্পরিক আস্থা পুনর্গঠিত হতে পারে। সমতার ওপর ভিত্তি করে নতুন এক অংশীদারত্ব তৈরি হতে পারে, যা ভঙ্গুরতার বদলে স্থিতিশীলতায় ভর করবে। দুই দেশের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, এই সম্পর্ক তখনই ভবিষ্যতের দিকে আরও দৃঢ়ভাবে এগোতে পারবে।
বাংলাদেশ সময়: ৫:৫৮:৫৬ ১৩ বার পঠিত