বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫

রডে ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ৬ গুলি, সাক্ষ্য দিতে এসে যা বললেন সেই তরুণ

প্রথম পাতা » আদালত সংবাদ » রডে ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ৬ গুলি, সাক্ষ্য দিতে এসে যা বললেন সেই তরুণ
শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫



রডে ঝুলে থাকা অবস্থায় পুলিশের ৬ গুলি, সাক্ষ্য দিতে এসে যা বললেন সেই তরুণ

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় (গত বছরের ১৯ জুলাই) রাজধানীর রামপুরা এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ওইদিন রামপুরা এলাকায় একটি ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেন (১৮) নামে এক যুবককে গুলি করে গুরুতর আহত করে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, গুলির ভয়ে নির্মাণাধীন ভবনের ৪র্থ তলার ছাদে তিনি উঠেছিলেন। তিনজন পুলিশ তার পিছু নিয়ে ছাদের উপরে ওঠে। পুলিশদের আসতে দেখে তিনি ছাদের সঙ্গে একটি রড ধরে ঝুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ সদস্যরা এ সময় পিস্তল দিয়ে পরপর ৬ রাউন্ড গুলি করলে তার পায়ে বিদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারান। জবানবন্দি শেষে এই মামলার গ্রেফতার অন্যতম আসামি এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের পক্ষে জেরা করেন আইনজীবী সারোয়ার জাহান। জেরার এক পর্যায়ে সাক্ষীর প্যান্ট খুলে লুঙ্গি পরিয়ে গুলির চিহ্ন দেখেন ওই আইনজীবী।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এই মামলায় গত ৭ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনকে আসামি করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। বাকি চার আসামি হলেন-ডিএমপির খিলগাঁও অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান, রামপুরা থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া ও রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) চঞ্চল চন্দ্র সরকার। পাঁচ আসামির মধ্যে শুধু চঞ্চল গ্রেফতার আছেন। বাকিরা পলাতক। এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এদিন জবানবন্দিতে আমির হোসেন আরও বলেন, ‘২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলনের সময় আমি আফতাবনগরে মামা কফিশপ নামক একটি খাবারের দোকানে চাকরি করতাম। আমি রামপুরা থানাধীন মেরাদিয়া এলাকায় আমার ফুফুর সঙ্গে থাকতাম। ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজের পর দোকান থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। রামপুরা খালের ওপর সাঁকো পাড় হয়ে মেইন রাস্তায় ওঠার পর দেখতে পাই, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাচ্ছে। ভয়ে আমি পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ৪র্থ তলার ছাদে ওঠে যাই। তিনজন পুলিশ আমার পিছে পিছে ছাদের উপরে ওঠে আসে। পুলিশদের আসতে দেখে আমি ছাদের সঙ্গে একটি রড ধরে ঝুলে আশ্রয় নেই। একজন পুলিশ আমাকে সেখান থেকে নিচে ঝাঁপ দিতে বলে। আমি ঝাঁপ না দিয়ে রড ধরে ঝুলে থাকি। তখন ওই পুলিশ সদস্য আমাকে পিস্তল দিয়ে পরপর ৩ রাউন্ড গুলি করে। ৩টি গুলিই আমার পায়ে বিদ্ধ হয়। তারপর সে চলে যায়। আরেকজন পুলিশ এসে পিস্তল দিয়ে আরও ৩ রাউন্ড গুলি করে। সেই ৩ রাউন্ড গুলিও আমার দুই পায়ে লাগে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরে এলে আমি দেখতে পাই যে, ফেমাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছি। ডাক্তাররা আমার পায়ের গুলিবিদ্ধ স্থানে সেলাই ও ব্যান্ডেজ করছে।

খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে আমার ফুফু হাসপাতালে আসেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাত ১২টার দিকে আমাকে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে ৩ দিন ভর্তি থাকার পর যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে বাসায় চলে আসি এবং বনশ্রী এলাকার ফরাজী হাসপাতালে চিকিৎসা নেই।

আমাকে গুলি করার ভিডিও কিছুদিন পরে ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও দেখে কয়েকজন ছাত্র আমার বাসায় আসে এবং তারা আমাকে টঙ্গী আহসানিয়া হাসপাতালে চিকিৎসা করায়। সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসা শেষে আমাকে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে আসে। গুলিতে আমার পায়ের রক্তনালি ছিঁড়ে যাওয়ায় আমার একটি অপারেশন করা হয়। সেখানে আমি এক মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম।

এরপর আমাকে সাভার সিআরপি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে আমি ৩/৪ মাস ফিজিও থেরাপি ও অন্যান্য চিকিৎসা নেই। এখনো মাঝে মাঝে আমাকে সেখানে যেতে হয়। আমি আমার পায়ের আঙ্গুল ঠিকমতো নাড়াতে পারি না। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি যে, রামপুরা থানার ওসি, এএসআই চঞ্চল ও এসআই তরিকুল আমাকে গুলি করেছিল। আরও জানতে পারি এএসআই চঞ্চল ধরা পড়েছে। এসআই তরিকুল পালিয়ে গেছে। আমাকে যারা বিনা কারণে গুলি করেছে, আমি তাদের শাস্তি চাই।’

পরে সাক্ষী আমির হোসেনকে জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবী সারোয়ার জাহান ও আমির হোসেন। তাদের সহায়তা করেন, আইনজীবী এরশাদুল হক বাবু ও সারমিন সুলতানা। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩৫:৫২   ২৭ বার পঠিত