ভারত শেখ হাসিনাকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত দেবে না

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ভারত শেখ হাসিনাকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত দেবে না
শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫



ভারত শেখ হাসিনাকে কোনো অবস্থাতেই ফেরত দেবে না

গত ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী আদালত (আইসিটি)। রায়ের পর দেখা গেল, প্রায় সর্বশ্রেণির মানুষ ওইটুকুতে সন্তুষ্ট নন।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ তো বলেই ফেললেন, যে রায় হয়েছে তার চেয়েও বড় শাস্তি হওয়া উচিত ছিল শেখ হাসিনার। তবে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে বড় আর কোনো শাস্তি তো নাই। তাই ওইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে আর্গুমেন্ট করার সময় বলেন, শেখ হাসিনা এত অপরাধ করেছেন যে, তাকে অসংখ্যবার দণ্ড দিতে হবে। তিনি ১৪শ মানুষ খুন করেছেন। এজন্য তাকে ১৪শ বার ফাঁসি দেওয়া দরকার। কিন্তু ফাঁসি তো একবারই হয়।

আমি ১৭ তারিখ সকাল থেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে ছিলাম। ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের জাজমেন্ট পুরোটাই মনোযোগ দিয়ে শুনি। আদালত কক্ষে ছিল না তিল ধারণের ঠাঁই। ছিল পিনপতন স্তব্ধতা। মাননীয় বিচারক গোলাম মর্তূজা মজুমদার ঘোষণা করেন, ১ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, এজন্য ট্রাইব্যুনাল তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করল। এ ঘোষণার পর দেখা গেল, জনাকীর্ণ আদালতে সবাই মুখ গোমরাহ করে বসে আছেন। সোজা কথা, আমৃত্যু কারাদণ্ড কাউকেও খুশি করতে পারেনি। কিন্তু যখন তিনি ঘোষণা করেন যে, ২ এবং ৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

এজন্য ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করছে, মাননীয় বিচারকের এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আদালতে উপস্থিত বিপুলসংখ্যক আইনজীবী, সাংবাদিক ও অন্যদের বিপুল করতালিতে মুখরিত হলো আদালত কক্ষ। তখন বিচারক গোলাম মর্তূজা এমন একটি নির্দেশ দেন, যা বিচার বিভাগের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, আপনারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চাইলে আদালতের বাইরে গিয়ে করুন। প্লিজ, আদালতের মধ্যে নয়। দয়া করে আদালতে আদালতের পরিবেশ রক্ষা করুন। কী আশ্চর্য, আদালতে উপস্থিত সব মানুষ সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে বিচারকের নির্দেশকে মান্য করেন।

মানুষ যে অতটুকু, অর্থাৎ শুধু মৃত্যুদণ্ড ঘোষণায় সন্তুষ্ট নন, তারা যে আরও বেশি কিছু চান, সেটি বোঝা গেল আদালতের বাইরে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা বাইরে অপেক্ষমান বিরাট জনতার প্রতিক্রিয়া ধারণের জন্য তাদের সামনে মাইক্রোফোন নিয়ে যান। বলতে গেলে প্রায় সবাই একবাক্যে বলেন, মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আমরা খুশি। কিন্তু আমরা সেদিনই সম্পূর্ণ খুশি হব, যেদিন শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া থেকে এনে রায় কার্যকর করা হবে। ওই যে আদালতের বাইরে এ আওয়াজ উঠল, অতঃপর সন্ধ্যার মধ্যেই সেই আওয়াজ ছড়িয়ে গেল সারা বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি স্থান থেকে টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা খবর পাঠাতে লাগলেন, জনগণ চায় অতি দ্রুত রায়টি কার্যকর করা হোক।

ওইদিকে পান্থপথ ছাড়িয়ে ৩২ নম্বরের মুখে, মুখে নয়, বরং বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের কাছে নির্মিত ফুটওভারব্রিজ পর্যন্ত জনতা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ইট-পাটকেল ছুঁড়ছেন। নিরাপত্তা বাহিনীও কখনো টিয়ার গ্যাস, আবার কখনো সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছেন। এখানে কীসের গোলমাল? গোলমালটি হলো, জনতা ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের ভাঙা বাড়িতে হামলা করতে চান। এর আগে ওই বাড়িটি ক্রুদ্ধ জনতা ভেঙেছেন। তারপরও কিছু ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।

মানুষ ওইগুলোও ভাঙতে চান। তারা ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে চান। শেখ মুজিব এবং তার কন্যা শেখ হাসিনার কোনো চিহ্ন বাংলাদেশে তারা রাখতে চান না। রায়ের দিন বোঝা গেল, নির্বাচন বা সংস্কার নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈধতা থাকলেও শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার ব্যাপারে সবাই এক পয়েন্টে। অর্থাৎ এ দুই ব্যক্তি সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনো আপস নাই।

২.

এখানেই আসছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। জনগণের দাবি, অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে রায় কার্যকর করা হোক। এটি বলা যত সহজ, করা কি তত সহজ? মোটেই না। আমার ব্যক্তিগত মত, বিরাজমান উপমহাদেশীয় রাজনীতির পটভূমিতে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়? সম্ভব নয় এজন্যই যে, ইন্ডিয়া শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না। ১৯ নভেম্বর আমি গ্রীন রোডে একজন নামকরা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কোন আইনে ভারত হাসিনাকে ফেরত দেবে না? আমার উত্তর ছিল নিুরূপ :

আপনি বলুন, কোন আইনে ভারত কাশ্মীরের ১ কোটি মানুষকে তাদের দখলে রেখেছে? কোন আইনে হায়দরাবাদ ভারতের অংশ? কোন আইনে জুনাগড় মানভাদার, সিকিম ইত্যাদি ভারতের অংশ? সেভেন সিস্টার্স অর্থাৎ ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল এবং সেই সঙ্গে পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে ভারত গণভোট দিক। প্রশ্ন থাকবে, এ ৯টি প্রদেশের মানুষ কি ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়? নাকি তারা স্বাধীন হতে চায়? উত্তর অবশ্যই হবে, তারা স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো সব পাওয়া যায় না।

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর আকৃতি বিশাল। চীনের পরই তার সামরিক বাহিনীর আকৃতি। জনবল ১৪ লাখ। এ ১৪ লাখের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মোতায়েন রয়েছে ওপরের ৯টি প্রদেশে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সামরিক শক্তিবলে দাবিয়ে রাখার জন্য।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভারত শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় বসায়। সাড়ে ৩ বছর পর বাংলাদেশ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। অবশেষে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ভারত শেখ হাসিনার সরকার গঠনের মাধ্যমে হারানো বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার আশা করে। জনমতের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্য বানানোর সাহস পাননি। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে ভারত হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকে বাংলাদেশকে কব্জা করে। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ তথা পশ্চাদভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ ভারতের উপনিবেশবাদী শোষণের জিঞ্জির ছিন্ন করেন।

৩.

ভারত কোনোদিন বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব চায়নি। তারা চেয়েছে একটি তাঁবেদার সরকার, যারা ভারতের শাসন এবং শোষণকে অবনত মস্তকে মেনে নেবে। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত আর কে হতে পারে? সবাই ধারণা করছেন, আগামী ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু ক্ষমতায় এলেও বিএনপি কি ভারতের পদলেহনের সাহস পাবে? বিগত ৪৫ বছর ধরে বিএনপি যে ইমেজ গড়ে তুলেছে, সেই ইমেজ কি সে রাতারাতি ভাঙার সুযোগ দিতে পারে?

এসব কারণেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। এসব কারণেই ভারত শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় ১ লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থককে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েই বিগত ১৫ মাস শেখ হাসিনা ভারতের মাটিতে বসে প্রকাশ্যে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালিয়েছে। এমনটি তো নয় যে, গত বছরের ৫ আগস্ট তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে হাসিনা ভারত গেলেন, আর ভারতও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে গ্রহণ করল। আসলে হাসিনার বিমানটি ভারতের উদ্দেশে বাংলাদেশ থেকে টেকঅফ করার ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে ২ দেশের মধ্যে হাসিনার সেফ এক্সিট এবং ভারতে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা চলছিল এবং সব বন্দোবস্ত ৫ আগস্টের প্রথম প্রহরে পাকাপোক্ত হয়। সেজন্যই হাসিনার ভারতে আগমনের প্রায় ২ ঘণ্টা আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একসঙ্গে বসে অধীর আগ্রহে শেখ হাসিনার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন। সেজন্যই ভারতের জেমস বন্ড অজিত দোভালকে এক ঘণ্টা আগেই হিন্দন বিমান ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। সেজন্যই হিন্দন ঘাঁটিতে অবতরণের পর অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে রিসিভ করেন।

৪.

তারপরের ১৫ মাসের ইতিহাস আপনারা সবাই জানেন। এ জয়শঙ্করই লোকসভায় কংগ্রেসের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, মাত্র কয়েক দিনের জন্য তারা শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিচ্ছেন। সেই কয়েক দিন ১৫ মাসে পরিণত হয়েছে। এখন শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দালাইলামা হয়ে দিল্লিতে অবস্থান করছেন। স্মরণ করা যেতে পারে, চীন তিব্বত অভিযান করলে তিব্বতের ধর্মীয়-কাম-রাজনৈতিক শাসক দালাইলামা (চতুর্দশ) ১৯৫৯ সালের মার্চে পালিয়ে ভারতে আসেন। ভারতে আসার পর তার স্বপ্ন ছিল, ভারতের সহযোগিতায় তিব্বত পুনর্দখল। আজ ৬৬ বছর ৮ মাস হলো, দালাইলামার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। সেই স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে, এমন কোনো আশার আলো নাই।

দালাইলামার মতো ভারত হাসিনাকেও আশ্রয় দিয়েছে ওই আশায় যে একদিন আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশে আবার ভারতীয় প্রভুত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের জনসাধারণ মনে করেন, ভারত এবং হাসিনার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

বাংলাদেশের জীবনের ৫৫টি বছর পার হয়ে গেছে। এ ৫৫ বছরেও মানুষ মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর অত্যাচার ভোলেনি। তেমনি আগামী ৫০ বছর পার হবে। কিন্তু জনগণ ২০২৪-এর বিপ্লব এবং শেখ হাসিনার সুপিরিয়র কমান্ডে ১৪শ মানুষের গণহত্যা এবং ২৬ হাজার মানুষের প্রাণঘাতী বুলেটের আঘাতে আহত হওয়ার রক্তাক্ত ঘটনা ভুলবে না। আজ হোক আর কাল হোক, ১৭ নভেম্বর আইসিটির ঐতিহাসিক রায় পুস্তক আকারে প্রকাশিত হবে। ৪৫০ পৃষ্ঠার ওই পুস্তকে লেখা থাকবে শুধু জুলাই বিপ্লব নয়, বরং শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দুঃশাসন এবং গুম, খুন, আয়নাঘর, বিডিআর ম্যাসাকার, শাপলা ম্যাসাকার ও জুলাই গণহত্যার রক্তক্ষয়ী কাহিনি।

মোবায়েদুর রহমান : সিনিয়র সাংবাদিক

journalist15@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ১২:২৯:৪৯   ৩৮ বার পঠিত  




প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


সংকীর্ণ রশির ওপর ভারসাম্য রক্ষা কেন পুতিনের সফর ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক মহাশিক্ষা
ভারতে অবস্থান প্রসঙ্গে  হাসিনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে : জয়শঙ্কর
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে অচেতন করে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ পরিচালনা ‘নীতিগত ভুল’: জাতিসংঘ মহাসচিব
সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ
ধানমন্ডি ৩২–এ ফুল দিতে গিয়ে মারধরের শিকার সেই রিকশাচালককে অব্যাহতির সুপারিশ
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প সতর্ক সংকেত: প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ
গাজায় নতুন গণকবরের সন্ধান হত্যার পর বুলডোজার দিয়ে বালি চাপা
খালেদা জিয়াকে দেখতে এভারকেয়ারে গেলেন প্রধান উপদেষ্টা

Law News24.com News Archive

আর্কাইভ